Skip to main content

ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’

 


‘ফারায়েজ’ বা ‘মুসলিম উত্তরাধিকার বিধান’ নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি এবং আল কুরআনে উপস্থাপিত বণ্টন বিধির মধ্যে মিল ও অমিলের তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য এ অধ্যায়ে ফারায়েজ বা মুসলিম উত্তরাধিকারের বিধান নামে প্রচলিত বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।

প্রচলিত মতে ফারায়েজের মূল উৎসসমূহ 

প্রচলিত মতে, ফারায়েজের মূল উৎস ৪টি। যথা :

১. আল কুরআন
২. আল হাদীস
৩. ইজমা
৪. কিয়াস।

এছাড়া এর আরো কিছু আনুষঙ্গিক উৎস আছে, যেমন আরবীয় প্রথা এবং কল্যাণ নীতি ইত্যাদি।

ফারায়েজ বিষয়ক মতভেদ ও ভিন্ন ভিন্ন আইন এবং তার কারণ

‘ফারায়েজ’ বা ‘উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি’ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে সুন্নী আইন ও শিয়া আইনে মতভেদ রয়েছে। এছাড়া সুন্নীদের মধ্যেও হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী ইত্যাদি মতে বিভিন্নতা রয়েছে। এ বিষয়ে তাফসীর ও ফারায়েজের গ্রন্থগুলোতে বিস্তর মতপার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। এর কারণ হিসেবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, সুদ এবং উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আয়াত নবীজীবনের শেষবর্ষে নাজিল হয় এবং এরপর তিনি কিছুদিন মাত্র জীবিত ছিলেন বিধায় এ দুটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে যেতে পারেননি এবং এজন্য সুদ ও উত্তরাধিকারের বিষয়ে বিস্তর মতভেদের সুযোগ রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ‘ইয়াতীম নাতির উত্তরাধিকার লাভ’ এবং ‘কালালাহ’ সমস্যার প্রশ্নে।

সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি

উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি নিয়ে মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকায় বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতের সমন্বয়ে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপনই এক নজরে দেখার ক্ষেত্রে যথোপযোগী হবে। তাই নিম্নে বিভিন্ন ধারার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধি উপস্থাপন করা হলো।

প্রচলিত উত্তরাধিকার বণ্টন বিধির ভাষ্য অনুযায়ী, আল কুরআনে উল্লেখিত ফারায়েজের মূল ধারাসমূহ :

জবিউল ফুরুজঃ

এদের অংশ পবিত্র কোরআন শরীফে নির্ধারণ করে দেয়া আছে। জবিউল ফুরুজ হল ১২ জন। 

এদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ এবং বাকি ৮ জন মহিলা।


 ৪ জন পুরুষ হল - 


১) স্বামী, ২)পিতা, ৩)দাদা, ৪) সৎ ভাই (বৈপিত্রেয়)। 


৮ জন মহিলা হল -


 ১)স্ত্রী, ২)কন্যা, ৩)পুত্রের কন্যা, ৪)মাতা, ৫)দাদি এবং নানি, ৬)সহোদর বোন, ৭) সৎ বোন (বৈমাত্রেয়), ৮)সৎ বোন (বৈপিত্রেয়)।


 নির্ধারিত অংশের পরিমান নিম্নরূপঃ

(১) স্বামী ১/৪ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে।

(২) স্বামী ১/২ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে।

(৩) স্ত্রী ১/৮ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান থাকে।

(৪) স্ত্রী ১/৪ পাবে যখন সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে।

(৫) কন্যা ১/২ পাবে যখন একজন মাত্র কন্যা থাকে এবং পুত্র না থাকে।

(৬) কন্যা ২/৩ পাবে যখন দুই বা ততধিক কন্যা থাকে এবং পুত্র না থাকে।

(৭) কন্য অবশিষ্ট ভোগী হিসাবে পাবেন যখন এক বা একের অধিক পুত্র থাকে।

(৮) পুত্রের কন্যা পাবে ১/২ অংশ পাবে যখন একজন মাত্র পুত্রের কন্যা থাকে। যদি কোন পুত্র, পুত্রের পুত্র বা একের অধিক কন্যা এবং পুত্রের কন্যা না থাকে।

(৯) পুত্রের কন্যা ২/৩ ভাগ পাবে যখন দুই বা ততধিক পুত্রের কন্যা থাকে এবং পুত্র ও পুত্রের পুত্র এবং এবং একের অধিক কন্যা না থাকে।

(১০) পুত্রের কন্যা অবশিষ্ট ভোগী হিসেবে পাবেন। পুত্রের পুত্র না থাকলে সমান অংশ কা আইন অনুযায়ী।

(১১) পিতা ১/৬ অংশ পাবে পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকে।

(১২) পিতা ১/৬ অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন এক বা একরে অধিক কন্যা, পুত্রের কন্যা এবং পুত্রের পুত্র না থাকে।

(১৩) পিতা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন পুত্র বা পুত্রের পুত্র থাকে।

(১৪) মাতা ১/৬ অংশ পাবে যখন পুত্র ও পুত্রের পুত্র এবং দুই বা ততধিক ভাই বোন এবং পিতা থাকে।

(১৫) মাতা ১/৩ অংশ পাবে যখন পুত্র অথবা পুত্রের পুত্র এবং একের অধিক ভাই বোন না থাকে।

(১৬) মা ১/৩ অংশ পাবে যখন স্ত্রী, স্বামী এবং বাবা থাকে।

(১৭) দাদা ১/৬ অংশ পাবে যখন সন্তান এবং পুত্রের সন্তান থাকে এবং পিতা বা নিকটতম পিতামহ না থাকে।

(১৮) দাদা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে ১/৬ অংশ পাবেন যখন কন্যা অথবা পুত্রের কন্যা থাকে।

(১৯) দাদা অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যদি দূরবর্তী কোন অংশিদার বা অকশিষ্ট অংশ ভোগী না থাকে।

(২০) দাদী ১/৬ অংশ পাবেন যদি কোন মাতা বা মায়ের দিকে দাদী না থাকে।

(২১) পূর্ণ বোন ১/২ অংশ পাবেন যখন একজন মাত্র বোন থাকে এবং যদি কোন সন্তান, পুত্রের সন্তান, পিতা অথবা ভাই না থাকে।

(২২) পূর্ণ বোন ২/৩ পাবে যখন দুই বা ততধিক বোন থাকে এবং সন্তান, পুত্রের সন্তান, পিতা ও ভাই না থাকে।

(২৩) বোন অবশিষ্ট ভোগী হিসেবে পাবে যখন পূর্ণ ভাই থাকে বা এক বা একাধিক পুত্রের কন্যা থাকে এবং বোনকে বঞ্চিত করার মত কোন অংশিদার না থাকে এবং এক বা একাধীক কন্যাদের সহিত অবশিষ্ট ভোগী থাকে তারা কন্যাদের অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্ট ভোগী হবে।

(২৪) বৈমাত্রীক বোন পাবে ১/২ অংশ যখন একজন মাত্র বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা ও পূর্ণ ভাই বোন না থাকে।

(২৫) বোন পাবে ২/৩ অংশ যখন দুই বা ততধিক বৈমাত্রীক বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা ও পূর্ণ ভাই বোন না থাকে।

(২৬) বৈমাত্রীয় বোন পাবে ১/৬ ভাগ যখন একজন পূর্ণ বোন থাকে (বোন পাবে ১/২ এবং বৈমাত্রী বোন পাবে ২/৩, ১/২, ১/৬)।

(২৭) বৈমাত্রীয় বোন অবশিষ্ট অংশ ভোগী হিসেবে পাবে যখন কোন বৈমাত্রীয় ভাই, এক বা একাধিক কন্যা এবং পুত্রের কন্যা এবং বঞ্চিত করার মত কোন অংশিদার না থাকে।

(২৮) বৈমাত্রীয় ভাই ১/৬ অংশ পাবে যখন সুধু মাত্র একজন বৈমাত্রীয় ভাই থাকে এবং সন্তান, পুত্রের সন্তান ও পিতা না থাকে।

(২৯) বৈপিত্রীয় ভাই ১/৩ অংশ পাবে যখন সেখানে দুই বা ততধিক বৈপিত্রীয় ভাই থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।

(৩০) বৈপিত্রীয় বোন ১/৬ অংশ পাবে সেখানে একমাত্র বৈপিত্রীয় বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।

(৩১) বৈপিত্রীয় বোন ১/৩ অংশ পাবে যখন সেখানে দুই বা ততধিক বৈপিত্রীয় বোন থাকে এবং সন্তান, সন্তানের সন্তান এবং পিতা না থাকে।

আসাবা বা অবশিষ্টভোগীঃ

১। আসবা গণের চারটি শ্রেণী আছেঃ

শ্রেণী ১: ১) পুত্র, ২)কন্যা, ৩)পুত্রের পুত্র, ৪) পুত্রের কন্যা

শ্রেণী ২: ১)পিতা, ২)দাদা

শ্রেণী ৩: ১)সহোদর ভাই, ২) সহোদর বোন, ৩)সৎ ভাই (বৈমাত্রেয়), ৪)সৎ বোন (বৈমাত্রেয়), ৫)সহোদর ভাইয়ের পুত্র, ৬)সৎ ভাই(বৈমাত্রেয়) -এর পুত্র, ৭)সহোদর ভাইয়ের পুত্রের পুত্র, ৮) সৎ ভাই(বৈমাত্রেয়)-এর পুত্রের পুত্র।

শ্রেণী ৪: ১)চাচা, ২)চাচা (বৈমাত্রেয়), ৩)চাচাতো ভাই, ৪)চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়), ৫)চাচাতো ভাইয়ের পুত্র, ৬)চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়) এর পুত্র, ৭)চাচাতো ভাইয়ের পুত্রের পুত্র, ৮)চাচাতো ভাই (বৈমাত্রেয়) এর পুত্রের পুত্র

২। শুধুমাত্র পুরুষ অথবা মহিলা আসাবা হিসাবে থাকলে, অবশিষ্টাংশের সম্পুর্ণ অংশ পুরুষ অথবা মহিলা পাবেন, কিন্তু একই শ্রেণীর পুরুষ ও মহিলা একত্রে আসাবা হিসাবে থাকলে, পুরুষ ও মহিলাগণ ২:১ অনুপাতে অবশিষ্টভোগী হবেন।

সম্পত্তি বণ্টন প্রক্রিয়াঃ

ধাপঃ ০১ - প্রথমে সম্পত্তি জবিউল ফুরুজ দের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।

ধাপঃ ০২ - জবিউল ফুরুজ দের অংশ সমূহ যোগ এর পরে সম্পূর্ণ অংশটি ১ এর চেয়ে বেশী হলে, সকল অংশ আনুপাতিক হারে কমে আসবে যাতে সম্পূর্ণ অংশটি ১ হয়।

ধাপঃ ০৩ - যদি কোন আসাবা না থাকেন এবং সম্পূর্ণ অংশ ১ এর চেয়ে কম হলে স্বামী স্ত্রী এর অংশ ছাড়া জবিউল ফুরুজ অংশ সমূহ আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে যাতে মোট অংশটি ১ হয়। স্বামী/স্ত্রী এর অংশ কঠিনভাবে সুনির্দিষ্ট করা।

ধাপঃ ০৪ - আসাবা থাকলে অবশিষ্ট অংশ আসাবাগন পাবেন নিম্নের ক্রম অনুযায়ী পাবেনঃ

শ্রেণী ১ >শ্রেণী ২>শ্রেণী ৩>শ্রেণী ৪

(শ্রেণী ১ থাকলে পরের শ্রেণীর আসাবাগন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন ,শ্রেণী ২ থাকলে পরের শ্রেণীর আসাবাগন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন; এভাবে চলতে থাকবে)

Comments

Popular posts from this blog

স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি ভাগ-বণ্টন ও জরিপ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যৌথ মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে। নিচে বাংলায় ও ইংরেজি টার্মসসহ প্রক্রিয়া সংক্ষেপে দেওয়া হলো:

স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি ভাগ-বণ্টন ও জরিপ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যৌথ মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে। নিচে বাংলায় ও ইংরেজি টার্মসসহ প্রক্রিয়া সংক্ষেপে দেওয়া হলো: ১. ভূমি জরিপ (Land Survey) কেন প্রয়োজন? সঠিক মাপজোক (Accurate Measurement): জমির সীমানা ও আকার নির্ধারণ। অধিকার নিশ্চিতকরণ (Ownership Verification): শরিকানগণের অংশ নিশ্চিত। বিরোধ এড়ানো (Dispute Avoidance): ভবিষ্যৎ সমস্যার সমাধান। স্থাপনার পরিকল্পনা (Construction Planning): সঠিক নকশা তৈরির জন্য। ২. জমি ভাগ-বণ্টনের ধাপ (Steps for Partition): চুক্তি (Agreement): সকল শরিকের লিখিত সম্মতি। অ্যাডভোকেট বা নোটারি পাবলিক দ্বারা বৈধকরণ। বাটোয়ারা মামলা (Partition Suit): কোর্টে জমির দলিল, খতিয়ান ও দাগ নম্বর জমা দিয়ে মামলা। আদালত জরিপ কমিশনার নিয়োগ করবে। দলিল রেজিস্ট্রেশন (Deed Registration): নতুন দলিল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রি। ৩. স্থাপনার পূর্বশর্ত (Pre-requisites for Construction): বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদন (Approval): পৌরসভা বা পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদন। নথি আপডেট (Updated Documents): জমির রেকর্ড, প...

ভূমি জরিপ ফরম 4992.01

 ফরমটি পূরণ করতে হবে। গুগল ড্রাইভ ফাইল লিংক https://docs.google.com/document/d/1vUVdNs6kwq4N8rXmqFscJT5gt3Dw3TBd/edit?usp=sharing&ouid=109464932453128677265&rtpof=true&sd=true

ভূমি জরিপ কেন করা প্রয়োজন?

  ভূমিই  সম্পদ আবার ভূমিই বিপদ ভূমি জরিপ ভূমি জরিপ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া , যা জমির সীমানা , অবস্থান , আকার এবং অন্যান্য ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। এটি শুধুমাত্র জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসায় সাহায্য করে না , বরং উন্নয়ন পরিকল্পনা , পরিবেশ সংরক্ষণ , কৃষি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের জন্যও অপরিহার্য। ভূমি জরিপের প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে । ১ . জমির সীমানা নির্ধারণ ভূমি জরিপের মূল উদ্দেশ্য হল জমির সীমানা স্পষ্ট করা। সীমানা নির্ধারণে ভুল বা বিভ্রান্তি জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে। যখন জমির সীমানা পরিষ্কার থাকে , তখন মালিকানা সম্পর্কিত যে কোনো সমস্যার সমাধান সহজ হয়। যেমন , জমি কেনা বা বিক্রি করার সময় সীমানার স্পষ্টতা থাকলে আইনি ঝামেলা বা ভুলভাল মালিকানা দাবি হতে পারে না । ২ . বিরোধ নিষ্পত্তি ভূমি জরিপ জমির মালিকানা নিয়ে যে কোনো বিরোধ বা বিবাদ সমাধান করতে সাহায্য করে। অনেক সময়...